ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ -
১৮৫৪ থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে সংঘটিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পিছনে দুটি বিপরীতমুখী স্বার্থ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। যেমন একদিকে ছিল রাশিয়া কর্তৃক তুরস্ককে গ্রাস করার চেষ্টা তেমনই অন্যদিকে ছিল ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া কর্তৃক রাশিয়ার আগ্রাসন রোধ করে তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষা। এই দুই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। নিন্মে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণগুলি আলোচনা করা হল -
লন্ডনের সন্ধি ঃ ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া তুরস্কের ওপর উনকিয়ার স্কেলেস্কি-র সন্ধি চাপিয়ে দেয়। এরফলে বসফোরাস ও দার্দনেলস প্রণালীতে রুশ জাহাজ চলাচলের অধিকার পায়। এইভাবে রাশিয়ার শক্তিবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। কিন্তু রাশিয়ার এই শক্তি বৃদ্ধিতে অস্ট্রিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। তারা রাশিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। শেষপর্যন্ত ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে লন্ডনের সন্ধির দ্বারা ঠিক হয় যে, বসফোরাস ও দার্দনেলস অঞ্চলে সমস্ত দেশের যুদ্ধ জাহাজ প্রবেশ নিষিদ্ধ।
রাশিয়ার আগ্রাসন ঃ রাশিয়ার উদ্দেশ্য ছিল কৃষ্ণসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য কায়েম করা। এই উদ্দেশ্যে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার জার প্রথম নিকোলাস ইংল্যান্ডের কাছে তুরস্ককে রাশিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে ব্যবচ্ছেদের প্রস্তাব দেন।
ইংল্যান্ডের ভূমিকা ঃ রাশিয়ার এই প্রস্তাবে ইংল্যান্ড কোন মতামত না জানিয়ে চুপ ছিল এবং রাশিয়ার উদ্দেশ্যে বলেছিল, এখনই ইউরোপের রুগ্ন মানুষের মৃত্যু হবে না। ইংল্যান্ডের এই মন্তব্যে জার প্রথম নিকোলাস ভেবেছিলেন তুরস্কের ব্যবচ্ছেদে ইংল্যান্ড খুব বেশি অরাজি হবে না। কিন্তু রাশিয়া তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযান চালালে ইংল্যান্ড তুরস্কের হয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠে।
ফ্রান্সের যুদ্ধাকাঙ্ক্ষা ঃ একদিকে রাশিয়ার আগ্রাসন তো অন্যদিকে ইংল্যান্ডের প্রতিরোধ। এমতাবস্থায় ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন বিভিন্ন কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে উদ্ধত হয়। যেমন -
(i) তিনি অত্যন্ত সক্রিয় পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে বিশ্ব ইতিহাসে ফ্রান্সের গরিমা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিলেন।
(ii) তৃতীয় নেপোলিয়নের অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিল তিনি রাশিয়াকে পরাজিত করে ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ভিয়েনা সম্মেলনে গৃহীত সন্ধিগুলি ভাঙার চেষ্টা করছিলেন।
অস্ট্রিয়ার উদ্দেশ্য ঃ অস্ট্রিয়া উপলব্ধি করে যে, বলকান অঞ্চলে রাশিয়ার প্রবেশ ঘটলে অস্ট্রিয়ার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এজন্য অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক নিরপেক্ষতার নীতি গ্রহণ করে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সকে সহযোগিতা করে।
গ্রিক চার্চের অভিভাবকত্ব ঃ তুরস্কের অন্তর্গত জিশুখ্রিস্টের জন্মস্থান জেরুজালেমের গ্রোটোর গির্জা-সহ অন্যান্য কিছু পবিত্র স্থান গ্রিক খ্রিস্টান প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণের অধিকার রাশিয়ার হাতে অর্পণ করার জন্য ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়ার জার তুর্কি সুলতানের কাছে দূতের মাধ্যমে দাবি জানান। কিন্তু তুরস্ক রাশিয়ার এই দাবি অগ্রাহ্য করে। এরফলে রাশিয়া তুরস্কের অন্তর্গত মলডেভিয়া ও ওয়ালকিয়া প্রদেশ দুটি দখল করে নেয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের সূচনা হয়।
ভিয়েনা নোট ঃ তুরস্কের প্রতি রাশিয়ার আগ্রাসনে ভীত হয়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ইত্যাদি দেশ ভিয়েনা শহরে একত্রিত হয়ে ভিয়েনা নোট বা ভিয়েনা প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই প্রস্তাবের দ্বারা তারা মলডেভিয়া ও ওয়ালকিয়া অঞ্চল থেকে রুশ সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানায়। কিন্তু রাশিয়া এই দাবি অগ্রাহ্য করে। এরপর তুরস্কের পক্ষে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া যুদ্ধে যোগদান করে। এভাবে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল।
মূল্যায়ন ঃ ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত টানা দুই বছর যুদ্ধ চলার পর অবশেষে রাশিয়ার পরাজয় ঘটে। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধির দ্বারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের অবসান ঘটানো হয়। এই সন্ধির দ্বারা তুরস্কের ওপর রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিহত হয় এবং ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়া তুর্কি সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা ও স্বাধীনতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয়। এরপর তুরস্ককে আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে আনা হয়, এইভাবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে তুরস্কের অখণ্ডতা বজায় থাকে।
আরও পড়ুন ঃ